পেশাদার সংগীতে ২৫ বছর পূর্তির মুহূর্তে সংগীতশিল্পী তাহসান খান ঘোষণা করলেন, এটি তাঁর শেষ ট্যুর। নতুন গান, কনসার্ট—সবকিছু থেকেই সরে দাঁড়ানোর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। গত রোববার সন্ধ্যায় মেলবোর্নের মঞ্চে ভক্তদের সামনে এ ঘোষণা দিয়ে যেন আবেগে ভাসিয়ে দিলেন সবাইকে। এরপর সোমবার সকাল থেকে তাঁর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ উঠতেই বললেন, ‘রিটায়ার্ড মানুষ ভাই, নো ইন্টারভিউ প্লিজ।’ পরে হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্ন পাঠাতে বললেন, উত্তর যা বলেছেন, পাঠকদের জন্য তুলে ধরেছেন মনজুর কাদের
মেলবোর্নের কনসার্টে হঠাৎ আপনি বললেন, ‘এটা শেষ ট্যুর।’ দর্শকেরা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না। আপনার মুখে শোনা সেই ব্যাখ্যাটা আরেকবার শুনতে চাই—কখন মনে হলো, এবার থামা দরকার?
তাহসান খান : হ্যাঁ, এটাই শেষ কনসার্ট ট্যুর। ঢাকায় দু-একটা ইভেন্ট আগে থেকেই কমিটমেন্ট করা আছে। সেগুলো শেষ করেই সংগীতজীবনের ইতি টানছি। অনেক দিন থেকেই মনে হচ্ছিল, বিদায় নেওয়া প্রয়োজন। এবার সময়টা ঠিক মনে হচ্ছে।
দেশে-বিদেশে এখনো আপনার গান নিয়ে এত উচ্ছ্বাস, এত চাহিদা। জনপ্রিয়তার চূড়ায় দাঁড়িয়ে এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া নিশ্চয়ই সহজ ছিল না। মন তখন কী বলছিল?
তাহসান খান : সূর্যের মধ্যগগনে থাকা অবস্থায় প্রস্থান শ্রেয়, এই বিশ্বাসে আমি বিশ্বাসী।
আপনি বলেছিলেন, কিছু নতুন গানও বানাচ্ছেন। তাহলে ‘ক্যারিয়ার গুটিয়ে নেওয়া’ বলতে কী বোঝাতে চেয়েছেন—গান একেবারে ছাড়ছেন, নাকি শুধু লাইভ পারফরম্যান্স থেকে একটু দূরে সরে যাচ্ছেন?
তাহসান খান : তিনটা গান বানানো আছে। কিন্তু আর রিলিজ করব না। ‘পোরসেলিনা তাহসান’স প্লেলিস্ট’ প্রকল্পের শেষ গানটা হয়তো শুধু প্রকাশিত হবে। তারপর শেষ। এরপর আর কোনো নতুন গান প্রকাশ করব না।
মেলবোর্নের মঞ্চে বলছিলেন, গান থেকে সরে আসাটা খুবই স্বাভাবিক। এটা কি সময়ের দাবি ছিল, নাকি এর পেছনে আপনার নিজের কোনো দর্শন কাজ করেছে?
তাহসান খান : জীবনদর্শনে পরিবর্তনটা মুখ্য। কিন্তু তা নিয়ে ঘটা করে কিছু বলতে চাই না।
মঞ্চে বলেছিলেন, মেয়ের জন্যই এ সিদ্ধান্ত। মেয়ের বড় হয়ে ওঠা আপনাকে কীভাবে নতুন করে ভাবতে শিখিয়েছে?
তাহসান খান : মেয়ের কথাটা এসেছিল বয়স বোঝাতে। দাড়ি পেকে যাচ্ছে সব, এখন আর নিজের কাছেই প্রেমের গান গেয়ে মঞ্চ মাতানোটা মানানসই লাগে না। অনেকের জন্য হয়তো সহজ, আমার জন্য একটু বেমানান।
পরিবার আর স্টেজ—দুটোর ভারসাম্য রাখা কি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে কঠিন হয়ে যাচ্ছিল?
তাহসান খান : না, তেমন কিছুই নয়। তবে পাবলিক ফিগার হিসেবে বেঁচে থাকার ভারটা অসম্ভব বেশি। তা আর নিতে চাই না।
আপনি বলেছিলেন, ‘মঞ্চে লাফালাফি করে গান গাওয়ার মানে হয় না।’ এটা কি বয়স ও অভিজ্ঞতার সঙ্গে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যাওয়ার ফল?
তাহসান খান : মঞ্চে অথবা মঞ্চের বাইরে যতটুকু দেওয়ার দিয়েছি। পেয়েছিও অনেক বেশি মানুষের ভালোবাসা। আর কিছু দেওয়ার নেই মনে হচ্ছে। আর ভালোবাসা এই ২৫ বছরে এত পেয়েছি, সেই ভালোবাসার ভান্ডার নিয়েই বেঁচে থাকতে পারব। নতুন করে আর ভালোবাসা না পেলেও হবে।
আপনি তো শুধু গান গাইছেন না, লিখছেন, সুর করছেন—এসব চালিয়ে যাবেন তো?
তাহসান খান : না। আপাতত তেমন কিছুই ভাবিনি।
কনসার্ট না হলেও স্টুডিও বা অনলাইনে আপনাকে নিয়মিত শোনা যাবে কি?
তাহসান খান : না, শোনা যাবে না। সংগীতজীবনের ইতি টানছি তো।
প্রায় কোটি অনুসারীর ফেসবুক পেজ এবং ৩৫ লাখের ইনস্টাগ্রাম অ্যাকাউন্টেও আপনাকে দেখা যাচ্ছে না, এ নিয়ে যদি কিছু বলতেন?
তাহসান খান : অবসরে যাওয়া মানুষের এসবের প্রয়োজন নেই। আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম অসম্ভব টক্সিক। ভালোটুকুর চেয়ে খারাপের প্রচার এত বেশি যে অনেক দিন থেকেই অসম্ভব বিরক্ত লাগছিল। আমি চাই মানুষ আমাকে আস্তে আস্তে ভুলে যাক। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে থেকে গেলে তো ভুলতে সময় লাগবে।
ফেসবুক ও ইনস্টাগ্রাম কি একেবারে মুছে দিয়েছেন, নাকি নিষ্ক্রিয় করে রেখেছেন?
তাহসান খান : ডিঅ্যাকটিভেটেড।
এত বছরের এই সংগীতযাত্রা—পেছন ফিরে তাকালে কোন মুহূর্তটা সবচেয়ে মনে গেঁথে আছে?
তাহসান খান : এত এত স্মৃতি, মঞ্চে দাঁড়িয়ে হাজারো মানুষের সঙ্গে একসঙ্গে গান গাওয়াটাই সবচেয়ে বেশি বেশি মিস করব। সেই সময়গুলোই গেঁথে আছে।
এমন কোনো আফসোস কি থেকে গেছে, যা করতে চেয়েছিলেন কিন্তু হয়নি?
তাহসান খান : নাহ্, কোনো আফসোস নেই। প্রত্যাশার চেয়ে প্রাপ্তি এত বেশি যে মাঝেমধ্যে বিশ্বাসই হয় না। এত অসাধারণ জীবন আমাকে এ দেশের গানপ্রেমী মানুষ উপহার দিয়েছেন। ২৫ বছরে এত এত গান মানুষ নিজের করে নিয়েছেন, তারপর আর কি অপ্রাপ্তি থাকতে পারে? শুধুই কৃতজ্ঞতায় ভরা জীবন।
অভিনয়েও তো আপনাকে দেখা যায়। এরপর ভক্তরা আপনাকে কোথায় দেখতে পাবেন—অভিনয়ে, টিভিতে, নাকি একেবারেই অফস্ক্রিন?
তাহসান খান : অভিনয়ে আরও আগে ইতি টেনেছি। এবার গানের ইতি টানলাম।
মিউজিক ছাড়া অন্য কোনো কাজ বা শখে সময় দেওয়ার পরিকল্পনা আছে কি এখন? কীভাবে আগামীর জীবনের পরিকল্পনা করেছেন? আপনাকে কি বিনোদন অঙ্গনের কোনো আড্ডায়ও আস্তে আস্তে দেখা যাবে না?
তাহসান খান : বিনোদন অঙ্গনের আড্ডায় আর নেই। এটাই আমার শেষ সাক্ষাৎকার হয়ে থাকুক। অন্য কিছু পরিকল্পনা আছে। কিন্তু সেগুলো একান্তই ব্যক্তিগত। সেই বিষয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে বলতে চাই না। একটু বেশি ফিলসফিক্যাল শোনাবে।
ভক্তরা জানতে চান, কোনো একদিন আবার মঞ্চে ফিরবেন কি?
তাহসান খান : অসম্ভব মিস তো করবই। কিন্তু বিদায় মানে তো বিদায়।
যাঁরা এত বছর আপনার গান শুনে বড় হয়েছেন, ভালোবেসেছেন, তাঁদের জন্য আপনার বার্তা কী হবে?
তাহসান খান : ‘ধন্যবাদ তোমায়, সুরের বন্ধু ভেবেছ, তুচ্ছ এই মানবে, কিছু খুঁজে পেয়েছ’—একটা গান ছিল ‘পাথরের গল্পকার’ গানে; সেই গানটার দুটো লাইনই হয়তো বলতে চাই।
অনেকে আপনার এ সিদ্ধান্তে কষ্ট পাচ্ছেন। তাঁদের কী বলতে চান?
তাহসান খান : সত্যি বলতে, কষ্ট আমারই বেশি হচ্ছে, যে গানকে জীবনের সবচেয়ে বেশি ভালোবেসেছি, সেই গান ছেড়ে দেওয়াটা মোটেও সহজ সিদ্ধান্ত ছিল না। কিন্তু জীবনের কিছু অভিজ্ঞতা আর উপলব্ধি এতটাই তীব্র আর করুণ ছিল যে এই প্রস্থানই একমাত্র পথ, যা আমার জন্য খোলা। শুধু সাধারণ একটা জীবনে ফিরে যেতে চাই।
অস্ট্রেলিয়ার কনসার্ট শেষে কোথায় যাবেন, বাংলাদেশ নাকি যুক্তরাষ্ট্রে?
তাহসান খান : বাংলাদেশে আসব। সেখানকার কমিটমেন্ট শেষ করব।