রবিবার, ১৩ এপ্রিল ২০২৫, ১২:১৪ অপরাহ্ন

স্টারলিংকের বাণিজ্যিক যাত্রা তিন মাসের মধ্যে শুরু

  • সময়: বৃহস্পতিবার, ১০ এপ্রিল, ২০২৫, ১১.০৮ এএম
  • ১৪ জন

প্রযুক্তি টাইকুন ইলন মাস্কের স্টারলিংক পরীক্ষামূলকভাবে বাংলাদেশে কাজ শুরু করেছে। গতকাল বুধবার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অনুষ্ঠিত ‘বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনে’র উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে যাত্রা শুরু হয় সেবাটির। বিনিয়োগ সম্মেলন উদ্বোধন করেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। আগামী ৯০ দিনের মধ্যে স্টারলিংক বাণিজ্যিকভাবে যাত্রা করবে। এর ফলে নিরবচ্ছিন্নভাবে ইন্টারনেট সুবিধা পাবেন গ্রাহকরা।

এ বিষয়ে প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিশেষ সহকারী ফাইজ় তাইয়েব আহমেদ আমার দেশকে বলেন, ‘আমরা আশা করছি আগামী ৯০ দিনের মধ্যে স্টারলিংক বাংলাদেশে বাণিজ্যিকভাবে অপারেশন শুরু করতে পারবে। এজন্য প্রয়োজনীয় যে প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো আছে সেগুলো আমরা এখন চালিয়ে যাচ্ছি।’

তিনি বলেন, ‘বিভিন্ন হাইটেক পার্কসহ বিভিন্ন জায়গায় ভূমি বরাদ্দের বিষয়টি এগিয়ে যাচ্ছে। পাশাপাশি গ্রাউন্ড স্টেশন তৈরির কাজগুলো শুরু হয়েছে। আর গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো নন-জিওস্টেশনারি অরবিট (এনজিএসও) নীতিমালা পাস হয়েছে। পাস হওয়ার পরপরই স্টারলিংক মেম্বারশিপের জন্য বিডায় আবেদন করেছে এবং সেটাও অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তারপর বিটিআরসিতে তারা আবেদন করেছে। সেটাও অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সবকিছু মিলিয়ে এখন আর কার্যকরভাবে স্টারলিংকের বাংলাদেশে কাজ করতে বাধা নেই। এখন আমরা ইনস্টেলেশন ও কমিশনিংয়ের কাজগুলো করব। আশা করি আমরা ৯০ দিনের মধ্যে স্টারলিংককে বাণিজ্যিকভাবে উন্মুক্ত করতে পারব।’

গত ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্বের শীর্ষ ধনকুবের ইলন মাস্কের সঙ্গে ভিডিও কলে স্টারলিংক প্রসঙ্গে আলোচনা করেন ড. ইউনূস। এতে স্টারলিংকের পরিসেবা চালুর কার্যক্রম আরো গতিশীল হয়। এরপর গত মাসেও ঢাকায় বেশ কয়েকবার পরীক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।

বাংলাদেশে স্টারলিংকের সেবা চালু নিয়ে তৈরি হয়েছে ব্যাপক আগ্রহ ও আলোচনা। প্রযুক্তি ও সাধারণ মহলে এটি এখন আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু। অনেকেই জানতে চাইছেন এই সেবা কি সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে থাকবে, এবং এতে দেশের ইন্টারনেট কখনো আর বন্ধ হবে কি না।

তবে নিশ্চিত করেই বলা যায়, মার্কিন প্রযুক্তি জায়ান্ট স্পেসএক্সের পরিচালিত স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা স্টারলিংক যদি বাংলাদেশে পুরোদমে চালু হয়, তাহলে দেশের ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবস্থায় এক নতুন যুগের সূচনা ঘটবে। এটি বিশেষ করে গ্রামীণ ও দুর্গম এলাকার ডিজিটাল বৈষম্য কমাতে এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য শিক্ষা, উদ্ভাবন ও উদ্যোক্তা হওয়ার নতুন পথ উন্মুক্ত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।

নিয়ন্ত্রক সংস্থার অনুমোদন ও নীতিমালা

২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) ‘এনজিএসও স্যাটেলাইট সেবা পরিচালনা নির্দেশিকা’ খসড়া প্রণয়ন করে। এই নির্দেশনা অনুযায়ী, শতভাগ বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানিও বাংলাদেশে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা প্রদানে লাইসেন্স পেতে পারবে। এতে স্টারলিংকের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দেশের বাজারে প্রবেশের বৈধতা পাচ্ছে।

বিটিআরসির এই পদক্ষেপকে একটি বড় অগ্রগতি হিসেবে দেখা হচ্ছে। তবে এই সেবার বাস্তবায়নের আগে বাণিজ্যিক চুক্তি, হার্ডওয়্যার আমদানি এবং প্রযুক্তিগত ও অবকাঠামো স্থাপনসহ বেশ কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে হবে।

কীভাবে কাজ করে স্টারলিংক

স্টারলিংক হলো এক ধরনের উপগ্রহভিত্তিক (স্যাটেলাইট) ইন্টারনেট ব্যবস্থা, যা পৃথিবীর চারপাশে অরবিটে (কক্ষপথে) ঘুরে বেড়ানো হাজার হাজার লো-আর্থ অরবিট স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ব্যবহারকারীদের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করে। এই প্রযুক্তি ভূ-ভাগে স্থাপিত মোবাইল টাওয়ার বা অপটিক্যাল ফাইবারের ওপর নির্ভর না করে সরাসরি মহাকাশ থেকে সিগন্যাল পাঠায় এবং গ্রহণ করে।

স্টারলিংক যেসব দেশে বর্তমানে তাদের ইন্টারনেট সেবা চালু রেখেছে, সেসব দেশেই তারা নিজস্ব গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন করেছে। এই গ্রাউন্ড স্টেশনগুলো হলো স্টারলিংক স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যার মাধ্যমে মহাকাশে অবস্থিত স্যাটেলাইটগুলোর সঙ্গে পৃথিবীর স্থলভাগে ইন্টারনেট ট্র্যাফিক বিনিময় সম্ভব হয়।

প্রতিটি গ্রাউন্ড স্টেশন সাধারণত ৯টি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন অ্যান্টেনা দিয়ে তৈরি হয়। এই অ্যান্টেনাগুলো বিশেষভাবে ডিজাইন করা হয় যাতে স্টারলিংকের লো-আর্থ-অরবিট স্যাটেলাইটগুলো থেকে উচ্চগতির ডেটা সিগন্যাল গ্রহণ করা যায়। সিগন্যাল গ্রহণের পর, সেই ডেটাগুলো প্রক্রিয়াকরণের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত ডেটা সেন্টারে পাঠানো হয়।

এই ডেটা পরিবহন প্রক্রিয়ায় সাবমেরিন ক্যাবল একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গ্রাউন্ড স্টেশনে স্যাটেলাইট থেকে প্রাপ্ত ডেটা সিগন্যালগুলো দ্রুতগতির অপটিক্যাল ফাইবার সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে গ্লোবাল ইন্টারনেট অবকাঠামোর সঙ্গে যুক্ত হয়। এর ফলে ব্যবহারকারীরা পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তে বসে কম লেটেন্সি ও উচ্চগতির ইন্টারনেট সুবিধা পেতে পারেন।

এই পুরো প্রক্রিয়াটি স্যাটেলাইট থেকে গ্রাউন্ড স্টেশন, সেখান থেকে সাবমেরিন ক্যাবল হয়ে ডেটা সেন্টারে পৌঁছানো স্টারলিংকের গ্লোবাল কানেক্টিভিটির মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করে।

কোথায় হতে পারে স্টারলিংকের গ্রাউন্ড স্টেশন

বাংলাদেশে স্টারলিংকের সেবা চালু করতে হলে প্রতিষ্ঠানটিকে গ্রাউন্ড স্টেশন বা গেটওয়ে স্থাপন করতে হবে। বিটিআরসির একটি সূত্র জানায়, দেশে একাধিক গ্রাউন্ড স্টেশন প্রতিষ্ঠিত হবে। গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপনের জন্য ইতোমধ্যে স্টারলিংক দেশের বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগাযোগ করছে। স্টারলিংকের সেবার প্রকৃতি অনুযায়ী, সাবমেরিন ক্যাবলের নিকটবর্তী স্থানে গ্রাউন্ড স্টেশন স্থাপন সবচেয়ে কার্যকরী হতে পারে। এর ফলে, স্যাটেলাইটভিত্তিক সেবা প্রদানে গ্রাউন্ড স্টেশন থেকে ইন্টারনেট সংযোগ পাওয়া যাবে এবং এনটিটিএন অপারেটরদের উপর নির্ভরশীলতা কমে যাবে। তবে, এ বিষয়ে স্টারলিংক কর্তৃপক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক তথ্য প্রকাশ করা হয়নি।

বাংলাদেশি প্রতিষ্ঠানের ব্যান্ডউইডথ বিক্রির সম্ভাবনা

এনজিএসও লাইসেন্সের আওতায় স্টারলিংকসহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে ব্যান্ডউইডথ ক্রয় করতে হবে দেশের আইআইজি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে। এ ক্ষেত্রে, যদি সরকারি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে গেটওয়ে সংযুক্ত করা হয়, তবে আবেদন ফি, বার্ষিক লাইসেন্স ফিতে ২৫ শতাংশ ছাড়ের সুবিধা ঘোষণা করা হয়েছে। এর ফলে, বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবলস পিএলসি (বিএসসিপিএলসি) এবং বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ কোম্পানি লিমিটেড (বিটিসিএল) স্টারলিংককে ব্যান্ডউইডথ বিক্রির ক্ষেত্রে সুবিধাজনক অবস্থানে থাকতে পারে।

সরকার কি চাইলেই বন্ধ করতে পারবে স্টারলিংক-এর সেবা

এনজিএসও নীতিমালায় সরাসরি কোনো সেবা বন্ধের সুযোগ না থাকলেও, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে আইনগতভাবে ইন্টারসেপশনের সুযোগ রাখা হয়েছে। তবে এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো পরবর্তী সময়ে কোনো সরকার যদি রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক কারণে স্টারলিংকের সেবায় হস্তক্ষেপ করে সেটি বন্ধ করতে চায়, তবুও এ সেবা পুরোপুরি বন্ধ করা সম্ভব নয়।

স্টারলিংকের নিজস্ব ইন্টারস্যাটেলাইট যোগাযোগ ব্যবস্থা রয়েছে, যার মাধ্যমে এটি একটি দেশের গেটওয়ে ছাড়াও অন্য দেশের গেটওয়ে ব্যবহার করে ইন্টারনেট সেবা দিতে পারে। বাংলাদেশে স্টারলিংকের কোনো গেটওয়ে স্থাপনা না থাকা সত্ত্বেও সম্প্রতি পরীক্ষামূলকভাবে উচ্চগতির সংযোগ পাওয়া গেছে—এটি তারই প্রমাণ। অর্থাৎ, সরকার যদি গেটওয়ে স্থাপনার অনুমতি না দেয় বা ভবিষ্যতে তা বন্ধও করে, তবুও স্টারলিংকের সেবা পুরোপুরি রোধ করা বাস্তবিক অর্থে প্রায় অসম্ভব। এটি স্যাটেলাইটনির্ভর ইন্টারনেটের বৈশিষ্ট্য ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতারই উদাহরণ।

দেশের ইন্টারনেট খাতের কতটা দখল নেবে স্টারলিংক

স্টারলিংকের সেবা সাধারণ মানুষের জন্য সহজলভ্য হওয়ার সম্ভাবনা কম, কারণ এ সেবা গ্রহণের জন্য গ্রাহককে শুরুতেই ৩৪৯ থেকে ৫৯৯ মার্কিন ডলারের বিশেষ ডিভাইস কিনতে হবে, যার সঙ্গে প্রতি মাসে একটি তুলনামূলকভাবে উচ্চ মূল্যের সাবস্ক্রিপশন ফিও গুনতে হবে। বর্তমান বাজার পরিস্থিতিতে যেখানে একজন ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারী মাত্র কয়েক হাজার টাকায় একটি রাউটার কিনে প্রতি মাসে মাত্র ৫০০ টাকার মতো খরচে আনলিমিটেড ইন্টারনেট সেবা পাচ্ছেন, সেখানে স্টারলিংকের ব্যয়বহুল সেবা সাধারণ গ্রাহকের আর্থিক সামর্থ্যের বাইরে পড়ে।

ফলে স্টারলিংকের সম্ভাব্য মূল গ্রাহক হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে অবস্থিত সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে। এর মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (BGB), র‍্যাব, বাংলাদেশ পুলিশ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর, বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি এবং বন বিভাগ—যাদের কাজ অনেক ক্ষেত্রেই দুর্গম এলাকায় বিস্তৃত। এ ছাড়াও রয়েছে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এনজিও প্রতিষ্ঠান যারা দেশের সীমান্তবর্তী ও দুর্গম অঞ্চলে শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সমাজ উন্নয়নমূলক কাজ পরিচালনা করে থাকে।

পাশাপাশি গ্রামীণ অঞ্চলে কাজ করা ফ্রিল্যান্সাররা স্টারলিংকের মাধ্যমে নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ পেতে পারে। এর বাইরের দেশের বিভিন্ন বড় করপোরেট হাউসগুলো এবং যারা উচ্চগতিসম্পন্ন নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা চান তারাও হতে পারেন স্টারলিংকের গ্রাহক।

স্থানীয় আইএসপিদের পড়তে হবে প্রতিযোগিতার মুখে

বাংলাদেশে বর্তমানে হাজারেরও বেশি আইএসপি প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা দেশজুড়ে ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে। স্টারলিংক যেহেতু ব্যয়বহুল, তাই এটি বাজারে এলে আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো সরাসরি বড় পরিসরে প্রতিযোগিতায় নাও পড়তে হতে পারে। যেসব প্রত্যন্ত এলাকায় এখনো ব্রডব্যান্ড পৌঁছায়নি, সেখানে স্টারলিংক সেবা চালু হলে তা আইএসপিগুলোর ব্যবসায় সরাসরি প্রভাব না ফেললেও করপোরেট ও প্রিমিয়াম গ্রাহকদের মধ্যে জনপ্রিয়তা পেতে পারে স্টারলিংক। এ ক্ষেত্রে দেশের আইএসপিগুলো কিছু গুরুত্বপূর্ণ বা উচ্চমানের গ্রাহক হারাতে পারে।

তবে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে দেশীয় আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য এটি হতে পারে আত্মবিশ্লেষণের সময়, যেখানে গুণগত সেবা, নিরবচ্ছিন্ন সংযোগ এবং উদ্ভাবনী সল্যুশনের মাধ্যমেই টিকে থাকা সম্ভব।

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved by BUD News 24-2025
Developed BY www.budnews24.com