দেশের ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) খেলাপি ঋণের পরিমাণ ২৬ হাজার ১৬৩ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে, যা বিতরণ করা মোট ঋণের সাড়ে ৩৫ শতাংশ, যা এ খাতের জন্য রেকর্ড। গত জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ ছিল ২৪ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। এ হিসাবে তিন মাসে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৪৫২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
খাতসংশ্লিষ্টরা বলেছেন, আর্থিক খাতের বহুল আলোচিত ব্যক্তি প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে যে অনিয়ম করে গেছেন, তার জের পুরো খাতকেই টানতে হচ্ছে। পি কে হালদারের মালিকানা ও ব্যবস্থাপনায় ছিল, এমন কয়েকটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানেই এখন খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি। আবার এতদিন যেসব খেলাপি ঋণ গোপন করা হয়েছে, তা বেরিয়ে আসছে। পুনঃতফসিল সুবিধা নেওয়া ঋণও খেলাপি হচ্ছে। এ ছাড়া ৫ আগস্টের পর অনেক ব্যবসায়ী পলাতক রয়েছেন, তাদের ঋণও এখন খেলাপি হচ্ছে। সব মিলিয়ে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ বেড়েছে।
তথ্য অনুযায়ী, ৩৪টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ২২ প্রতিষ্ঠানে উচ্চ খেলাপি ঋণ। এসব প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণের হার ৪০ শতাংশ থেকে প্রায় ১০০ শতাংশ পর্যন্ত রয়েছে। ১০ শতাংশ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত খেলাপি আছে ছয় প্রতিষ্ঠানে। আর তিনটি প্রতিষ্ঠানের খেলাপি ঋণ ৫ থেকে ১০ শতাংশের মধ্যে রয়েছে।
খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির কারণ জানতে চাইলে বাংলাদেশ লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্স কোম্পানিজ অ্যাসোসিয়েশনের (বিএলএফসিএ) চেয়ারম্যান গোলাম সারওয়ার ভূঁইয়া আমার দেশকে বলেন, ‘আগে অনেক প্রতিষ্ঠান খেলাপি ছিল, যা দেখানো হয়নি। কোভিডকালীন পুনঃতফসিল সুবিধাসহ অনেক ছাড় দেওয়া হয়েছিল। এখন ওইসব ঋণও খেলাপি হয়ে যাচ্ছে। যারা ভালো গ্রাহক তারা ঋণ পরিশোধ করছেন। এতে ঋণ স্থিতি কমে যাওয়ায় খেলাপি ঋণের হার বাড়ছে। তা ছাড়া খেলাপি ঋণ হওয়ার আরেকটি কারণ হলো আগস্টের সরকার পতনের পর অনেকে পালিয়েছে। এখানে অনেকে ব্যবসায়ী ছিলেন। তারা ঋণ পরিশোধ না করার কারণে খেলাপি হচ্ছেন। ফলে সার্বিকভাবে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।’
এদিকে জুলাই-সেপ্টেম্বর সময়ে প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত কমার পাশাপাশি ঋণের স্থিতিও কমে গেছে। তথ্য অনুযায়ী, গত জুনে আমানত ছিল ৪৭ হাজার ৯০৬ কোটি টাকা। এরপর গত সেপ্টেম্বরে আমানত কমে ৪৭ হাজার ৮৩৮ কোটি টাকায় নামে। আর গত জুন ঋণ ছিল ৭৪ হাজার ৯১৮ কোটি টাকা। সেপ্টেম্বরে ঋণ কমে ৭৪ হাজার ১৪০ কোটি টাকায় নামে।
এ বিষয়ে গোলাম সারওয়ার বলেন, ‘সরকারের বিল-বন্ড সুদহার বৃদ্ধির কারণে মানুষ সেখানে বিনিয়োগ করছে। কারণ এখানে বিনিয়োগ নিরাপদ। এরপর মানুষ ব্যাংকগুলোকে নিরাপদ মনে করে। তারপর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে আসে বিনিয়োগ। তাই সেভাবে এসব প্রতিষ্ঠান আমানত পাচ্ছে না। তাছাড়া এখন ১৩ শতাংশে আমানত সংগ্রহ করা যাবে। তবে সেটা বিনিয়োগ করা যাবে না। কারণ দেশের অথনৈতিক যে পরিস্থিতি এতে ব্যবসা-বাণিজ্যও সেভাবে হচ্ছে না। আবার ঋণের সুদহার বেশি হওয়ায় কেউ নতুন বিনিয়োগেও যাচ্ছে না। রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঠিক না হওয়া পর্যন্ত কেউ নতুন বিনিয়োগ করবে না।’
যেসব আর্থিক প্রতিষ্ঠানে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে বেশি সেগুলো হলো- পি কে হালদারসংশ্লিষ্ট আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে এফএএস ফিন্যান্সের খেলাপি ঋণের হারই সর্বোচ্চ ৯৯ দশমিক ৯২ শতাংশ বা ১ হাজার ৮২০ কোটি টাকা। অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোয় খেলাপি ঋণের হার ও পরিমাণ এরকম- পিপলস লিজিংয়ের খেলাপি ঋণের হার ৯৭ শতাংশ বা ১ হাজার ২৭ কোটি টাকা, ইন্টারন্যাশনাল লিজিং ৯৬ দশমিক ১৯ শতাংশ বা ৩ হাজার ৯৭৭ কোটি টাকা এবং আভিভা ফিন্যান্স ৮৯ দশমিক ৮১ শতাংশ বা ২ হাজার ৬২৯ কোটি টাকা।
এর বাইরে ফারইস্ট ফিন্যান্সের খেলাপি ঋণ ৯৮ দশমিক ০৬ শতাংশ বা ৮৭৩ কোটি, বিআইএফসি ৯৭.২৭ শতাংশ বা ৭৫১ কোটি, জিএসপি ফিন্যান্সের ৫৮ দশমিক ২৪ শতাংশ বা ৫০৯ কোটি, ফার্স্ট ফিন্যান্সের ৮৭ দশমিক ৮২ শতাংশ বা ৬৬৮ কোটি, প্রিমিয়ার লিজিংয়ের ৭৫ দশমিক ২০ শতাংশ বা ৯৮৫ কোটি, সিভিসি ফিন্যান্সের ৫৯ দশমিক ৫৪ শতাংশ বা ২২৪ কোটি, মেরিডিয়ান ফিন্যান্সের ৫৭ দশমিক ৬৯ শতাংশ বা ১৮১ কোটি, আইআইডিএফসির ৬৬ দশমিক ৭৪ শতাংশ বা ৬২১ কোটি, হজ ফিন্যান্সের ৫৫ দশমিক ৪৫ শতাংশ বা ৩৫৪ কোটি, ফিনিক্স ফিন্যান্সের ৮৮ দশমিক ৫৭ শতাংশ বা ২ হাজার ৩৩৪ কোটি, ন্যাশনাল ফিন্যান্সের ৬৩ শতাংশ বা ৩৪৩ কোটি, বে-লিজিংয়ের ৬৫ দশমিক ৮৭ শতাংশ বা ৫৫০ কোটি, উত্তরা ফিন্যান্সের ৫৬ দশমিক ৩৬ শতাংশ বা এক হাজার ৩২৮ কোটি, বাংলাদেশ ফিন্যান্সের ৪৪ দশমিক ৩৪ শতাংশ বা ৬০২ কোটি, ইসলামিক ফিন্যান্সের ৪৮.৬৫ শতাংশ বা ৪৮১ কোটি, মাইডাস ফিন্যান্সের ৪৮.৯৮ শতাংশ বা ৪৬৫ কোটি, প্রাইম ফিন্যান্সের ৭৭.৬২ শতাংশ বা ৫৪৩ কোটি এবং ইউনিয়ন ক্যাপিটাল ৯৪.৬০ শতাংশ বা এক হাজার ১৩৩ কোটি টাকা।