বাজারে সংকটের অজুহাতে চাল, আলু, চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম বাড়লেও বৈধ-অবৈধ বিভিন্ন গুদামে এসব নিত্যপণ্যের পাহাড় গড়ে তুলেছেন মুনাফালোভী মজুতদাররা। ফলে শুল্কছাড়সহ নানা উদ্যোগ নিয়েও বাজার নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সরকার। এ পরিস্থিতিতে বাজার বিশ্লেষকরা মজুতকৃত পণ্যের প্রকৃত হিসাব খতিয়ে দেখতে অবৈধ গুদাম চিহ্নিতকরণের পাশাপাশি বৈধ গুদামে অভিযান চালানোর তাগিদ দিয়েছেন।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, চাল, আলু, চিনি ও ভোজ্যতেলসহ বিভিন্ন নিত্যপণ্যের অবৈধ মজুত বন্ধ করা গেলে বাজারে সরবরাহ স্বাভাবিক হবে। এতে স্বল্পসময়ের মধ্যে এসব পণ্যের দামও কমে আসবে। সঠিক মজুত হিসাব সংগ্রহ না করে বাজারের কৃত্রিম সংকটে বিভ্রান্ত হয়ে চাল, আলুসহ কৃষিজাত অন্যান্য পণ্য বিদেশ থেকে আমদানি করা হলে দেশের কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাব অনুসারে, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কৃষকরা চার কোটি ছয় লাখ টন চাল পেয়েছেন। যা আগের অর্থবছরের তুলনায় চার দশমিক এক শতাংশ বেশি। শুষ্ক মৌসুমে বোরোর ফলন বেশি হওয়ায় গত মে থেকে জুনে বোরো আবাদ থেকে কৃষকরা পেয়েছেন প্রায় দুই কোটি ১০ লাখ টন ধান।
এদিকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের দেওয়া তথ্য বলছে, চলতি বছরের আগস্ট ও অক্টোবর মাসে ভারী বৃষ্টিপাত ও ভারতে থেকে নেমে আসা ঢলের পানিতে ভয়াবহ দুটি বন্যার মুখোমুখি হয় বাংলাদেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং উত্তরাঞ্চলের জেলাগুলো। ভয়াবহ এই বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে কৃষিপণ্যের। বিশেষ করে পূর্ব ও উত্তর অঞ্চলে ফসলের ক্ষতি হয়েছে সবচেয়ে বেশি। এতে করে চলতি বছরের বন্যায় বাংলাদেশে আনুমানিক ১১ লাখ মেট্রিক টন ধান নষ্ট হয়েছে। এজন্য অন্ততঃ ৫ লাখ টন চাল আমদানি করা জরুরি। যার উদ্যোগ এরইমধ্যে সরকার নিয়েছে।
অন্যদিকে বিবিএস’র তথ্য অনুযায়ী, দেশে মাথাপিছু দৈনিক চাল গ্রহণের পরিমাণ ৩২৮ দশমিক ৯ গ্রাম। আর শহরাঞ্চলে মাথাপিছু চাল গ্রহণের পরিমাণ ২৮৪ দশমিক ৭ গ্রাম, যা জাতীয় গড় থেকে ১৩ দশমিক ৪৪ শতাংশ কম। ১৭ কোটির মানুষের প্রতিদিনের হিসাব ধরে বছরে প্রয়োজন হয় প্রায় ২ কোটি ৬০ লাখ টন চাল।
শুধু ভাত হিসেবে এ চাল মানুষ গ্রহণ করে। এর বাইরে বিভিন্ন পোলট্রি ফিড, বীজসহ অন্যান্য প্রয়োজনে চাল ব্যবহার হয় ১ কোটি টন। সবমিলে প্রয়োজন ৩ কোটি ৬০ লাখ টন। কিন্তু গত বছরে উৎপাদন হয়েছে ৪ কোটি ১৩ লাখ টন।
ধান গবেষকরা বলছেন, চলতি বছরেও প্রায় একই পরিমাণ ধান উৎপাদন হয়েছে। তাই সাম্প্রতিক দু’দফার বন্যায় ১১ লাখ মেট্রিক টন ধান নষ্ট হলেও দেশে চালের বড় ঘাটতি দেখা দেওয়া কথা নয়। অথচ চাল সংকটের অজুহাতে গত দু’মাস ধরে ধাপে ধাপে মোটা-সরু সব ধরনের চালের দাম বাড়ানো হচ্ছে। এমনকি গত ১১ নভেম্বর থেকে ১৮ নভেম্বর পর্যন্ত হিলি স্থলবন্দর দিয়ে ৫ হাজার ১২৮ মেট্রিক টন চাল আমদানির পরও চালের দাম কমেনি।
বাজার পর্যবেক্ষকরা বলছেন, চালের বাজার অস্থিরতার নেপথ্যে মিলার, ধান-চালের মজুতদার, পাইকার ও বড় করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিশালী ‘সিন্ডিকেট’ কলকাঠি নাড়ছে। চালের সংকট না থাকলেও বাজারে চালের দামে চরম অস্থিরতা বিরাজ করছে। মুনাফালোভী সিন্ডিকেট চালের মজুত গড়ে তুলেছে। এরাই চালের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াচ্ছে। এ কারণে ব্যর্থ হচ্ছে সরকারের ইতিবাচক সব উদ্যোগ।
সরকারি সংস্থা টিসিবির হিসাবে, গত এক মাসে সরু চালের দর প্রায় ৪ শতাংশ, মাঝারি চালের ৮ ও মোটা চালের দর ২ শতাংশ বেড়েছে। তবে এক বছরের ব্যবধানে দাম বৃদ্ধির এই হার আরও বেশি। এ সময় সব ধরনের চালের দর বেড়েছে গড়ে ১২ শতাংশ।
চাল ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, মিলার, মজুতদার ও পাইকার এবং বেশ কয়েকটি বড় কোম্পানি চালের দামে ফায়দা লুটছে। তারা মৌসুমে কৃষকদের কাছ থেকে কম দামে ধান-চাল কিনে গুদামজাত করেছে। এখন কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে নিজেদের সুবিধামতো চালের দাম বাড়াচ্ছে। বড় বড় মিলারের গোডাউনে অভিযান চালানো হলে হাজার হাজার টন পুরানো চাল ও ধান পাওয়া যাবে বলে নিশ্চিত করেন তারা।
বাজার সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে চাল সিন্ডিকেটের মূল হোতা রশিদ এগ্রো. লিমিটেডসহ কয়েকটি গ্রুপ কোম্পানির স্বত্বাধিকার আব্দুর রশিদকে গ্রেপ্তার করা হলেও তার সিন্ডিকেটের অন্যরা এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়ে গেছে। রশিদকে গ্রেপ্তারের পর তারা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। চালের বাজার অস্থিতিশীল করে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে তারা উঠেপড়ে লেগেছে।
প্রসঙ্গত, প্রায় ১০ বছর ধরে চালের বাজার অস্থির করেছেন আব্দুর রশিদ। তার ইশারায় সারাদেশে চালের দাম ওঠানামা করত। চাল মজুত করে তিনি বাজারে কৃত্রিম সংকট তৈরি করতেন। এরপর সপ্তাহভেদে চালের দাম কেজিতে পাঁচ থেকে আট টাকা বাড়াতেন। এভাবে তিনি ও তার সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছেন হাজার কোটি টাকা।
এদিকে বেশ কয়েকজন চাল ব্যবসায়ীর সঙ্গে কথা বলে বিভিন্ন পর্যায়ে মজুতের তথ্য পাওয়া গেলেও কার কী পরিমাণ চাল মজুত করার বৈধতা আছে সে সম্পর্কে যে তাদের যথেষ্ট ধারণা নেই তা নিশ্চিত হওয়া গেছে। এছাড়া মিলারদের এ ব্যাপারে স্পষ্ট ধারণা থাকলেও এ বিষয়টিতে থোড়াই কেয়ার করার প্রমাণ মিলেছে। আইনে বলা হয়েছে- যেসব ব্যবসায়ীর লাইসেন্স নেই, তারা এক টনের বেশি ধান বা চাল কোনোভাবেই মজুত রাখতে পারবেন না। এ ছাড়া লাইসেন্সধারী খুচরা ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ ১৫ টন ধান বা চাল ১৫ দিনের জন্য মজুত রেখে ব্যবসা করতে পারবেন। লাইসেন্সধারী পাইকারি ব্যবসায়ীরা সর্বোচ্চ ৩০০ টন ধান বা চাল ৩০ দিনের জন্য মজুত রেখে ব্যবসা করতে পারবেন। এছাড়া লাইসেন্সধারী আমদানিকারকরা আমদানি করা শতভাগ ধান বা চাল ৩০ দিনের বেশি মজুত রাখতে পারবেন না।
তবে রাইস মিলে ধান ও চাল মজুত রাখার ব্যাপারে আলাদা আলাদা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। আইনে বলা হয়েছে, অটোমেটিক চালকলে প্রতি ১৫ দিনে ছাঁটাই ক্ষমতার ৫ গুণ ধান ও ২ গুণ চাল সর্বোচ্চ ৩০ দিন মজুত রাখা যাবে। এ ছাড়া মেজর চালকলে প্রতি ১৫ দিনে ছাঁটাই ক্ষমতার ৫ গুণ ধান সর্বোচ্চ ৩০ দিন ও ২ গুণ চাল সর্বোচ্চ ১৫ দিন মজুত রাখা যাবে। হাসকিং চালকলে প্রতি ১৫ দিনে ছাঁটাই ক্ষমতার ৫ গুণ ধান সর্বোচ্চ ৩০ দিন ও ১০০ টন চাল সর্বোচ্চ ১৫ দিন মজুত রাখা যাবে। আইনে বলা হয়েছে, কোনো ব্যবসায়ী যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে ধান বা চাল বিক্রি করতে না পারেন, তবে মেয়াদ শেষ হওয়ার সর্বোচ্চ ৩ দিনের মধ্যে সরকারের ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তা অবহিত করতে হবে।
অথচ এসব নিয়ম ছোট ব্যবসায়ী থেকে বড় মিলার কেউই মানছেন না। সংশ্লিষ্ট প্রশাসনেরও এ ব্যাপারে তদারকি নেই বললেই চলে। ফলে বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সংঘবদ্ধ সিন্ডিকেট গুদামে চালের পাহাড় গড়ে তুললেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না।
এদিকে আলুর বাজারও অস্থিতিশীল হয়ে ওঠার নেপথ্যে অবৈধ মজুতদারদের কারসাজি রয়েছে বলে বাজার পর্যবেক্ষকরা অভিযোগ তুলেছেন। তাদের ভাষ্য, সংকটের দোহাই দিয়ে দাম বাড়ানো হলেও এখনো অনেক কোল্ড স্টোরেজে বিপুল পরিমাণ আলু রয়েছে।
অতি সম্প্রতি বেসরকারি ভোক্তা অধিকার সংস্থা ‘কনশাস কনজ্যুমার্স সোসাইটি’ (সিসিএস) ও এর যুব শাখা ‘কনজ্যুমার ইয়ুথ বাংলাদেশ’ (সিওয়াইবি) এর স্বেচ্ছাসেবীরা যেসব কোল্ড স্টোরেজে আলুর মজুত রয়েছে সেগুলোতে অভিযান চালানোর জন্য জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরকে তিন দিনের আল্টিমেটাম দিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে কোল্ড স্টোরেজে অভিযান চালিয়ে মজুতকৃত আলু বাজারে ছেড়ে মূল্য নিয়ন্ত্রণে না আনলে আগামী রোববার অধিদপ্তর ঘেরাও করা হবে বলে জানিয়েছেন সিসিএস এর নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ।
গত ১৯ নভেম্বর সকালে কাওরানবাজারে অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে মহাপরিচালক মোহাম্মদ আলীম আখতার খান বরাবর স্মারকলিপি দিয়েছে সিসিএস ও সিওয়াইবির সদস্যরা। স্মারকলিপির সঙ্গে দেশের বিভিন্ন জেলায় আলুর মজুত রয়েছে এমন কোল্ড স্টোরেজের বিভাগ ও জেলাভিত্তিক তালিকা, অধিক মুনাফাখোর মজুতদারদের তালিকা ও কোল্ড স্টোরেজে সংরক্ষিত আলুর তথ্য সরবরাহ করা হয়।
জানা গেছে, অসাধু ব্যবসায়ীরা কোল্ড স্টোরেজ কেন্দ্রিক কূটকৌশলের মাধ্যমে আলুর বাজার নিয়ন্ত্রণ করে ভোক্তাদের জিম্মি করেছে। গত ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ থেকে মার্চ মাস পর্যন্ত মজুতদাররা আলু সংগ্রহ করে কোল্ড স্টোরেজে রেখেছেন। ওই সময় তাদের আলুর ক্রয় মূল্য ছিল কেজি প্রতি ১৮ থেকে ২০ টাকা। কোল্ড স্টোরেজে রাখার খরচ ৬০ কেজির বস্তাপ্রতি অঞ্চলভেদে ১৮০ টাকা থেকে ৩৪০ টাকা।
অথচ কিছু মজুতদার, বেপারী, ফড়িয়া (যাদের অধিকাংশের ট্রেড লাইসেন্স নেই) এবং সংশ্লিষ্ট কোল্ড স্টোরেজ কর্তৃপক্ষের যোগসাজশে অস্বাভাবিকভাবে মূল্য বাড়িয়ে কেজি প্রতি আলু খুচরা পর্যায়ে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা দরে বিক্রয় করছে। বিষয়টি ওপেন সিক্রেট হলেও এ সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে কখনই কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, বীজ আলু বাদ দিয়েও বিভিন্ন কোল্ড স্টোরেজে যে পরিমাণ আলু মজুত রয়েছে তা নিয়মমাফিক বাজারে ছাড়া হলে অনায়াসে সংকট কেটে যাবে। তবে এজন্য সাঁড়াশি অভিযান জরুরি বলে মনে করেন তারা।
এদিকে বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহে বড় ধরনের ঘাটতি তৈরি হলেও বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন বলে দাবি করেন ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াতেই দেশের ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী কোম্পানিগুলো সপ্তাহ দুয়েক ধরে সরবরাহকারীদের (ডিলার) কাছে বোতলজাত সয়াবিন তেল বিক্রি বন্ধ রেখেছে। এতে বিপাকে পড়েছেন ভোক্তারা।
সম্প্রতি ভোজ্যতেল পরিশোধনকারী ব্যবসায়ীরা বাণিজ্য উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠক করে ভোজ্যতেল আমদানিতে বিদ্যমান মূল্য সংযোজন কর (মূসক) হার ১০ শতাংশ থেকে কমিয়ে ৫ শতাংশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর বাজারে বোতলজাত সয়াবিন তেলের সরবরাহ বাড়াতে রাজি হলেও কার্যতঃ তা করা হয়নি বলেও অভিযোগ করেন তারা।
রাজধানীর কারওয়ান বাজারের একাধিক ডিলার জানান, ‘মিলগেট থেকে সয়াবিন (বোতলজাত) তেল কেনার জন্য তারা টাকা দিতে চাইলেও কোম্পানির লোকেরা টাকা নিচ্ছেন না, তেলও দিচ্ছেন না। ৮-১০ দিন ধরেই এ অবস্থা চলছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত বিভিন্ন সময় একই ধরনের কারসাজির মাধ্যমে তেলের বাজার অস্থিতিশীল করতে গুদামে শত শত টন মজুত করা হয়েছে। বাজার নিয়ন্ত্রণে সরকার সাঁড়াশি অভিযান চালানোর পর ‘থলের বিড়াল’ বেরিয়ে আসে। বিভিন্ন বৈধ-অবৈধ গুদাম থেকে বিপুল পরিমাণ সয়াবিন তেল জব্দ করা হয়।