রবিবার, ০৯ নভেম্বর ২০২৫, ০৩:১৮ অপরাহ্ন

দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশেও গড়েছেন সম্পদের পাহাড়

  • সময়: শনিবার, ২৬ অক্টোবর, ২০২৪, ১২.২০ পিএম
  • ১১৭ জন

ঢাকা আর্ট সামিট দেশি-বিদেশি শিল্পকর্ম নিয়ে বিভিন্ন প্রদর্শনীর আয়োজন করে, যা সর্বমহলে পরিচিত। এখানে যাতায়াত করেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন শিল্পী, ভাস্কর ও শিল্পসংগ্রাহকরা। এটির আয়োজক সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশন, যার কর্ণধার রাজীব সামদানী। তাকে সবাই চেনেন শিল্পকর্ম সংগ্রাহক ও ব্যবসায়ী হিসাবে। তাদের সংগ্রহে রয়েছে দেশবরেণ্য চিত্রশিল্পী এসএম সুলতান থেকে শুরু করে কোরীয় ভাস্কর হেগুয়ে ইয়াংয়ের শিল্পকর্ম।

বিশ্বখ্যাত মূল্যবান শিল্পকর্ম সরবরাহকারী হিসাবেও ইতোমধ্যে আলোচনায় এসেছেন রাজীব সামদানী। ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন ও একজন উপদেষ্টার বাড়িতে অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটে। সেসময় সেখান থেকে প্রায় ২৮০ কোটি টাকার মূল্যবান শিল্পকর্ম লুট হয় আর এসব শিল্পকর্ম রাজীব সামদানীর সরবরাহ করা ছিল বলে শোনা যায়। এরপর থেকেই মূলত থলের বিড়াল সামনে আসতে থাকে। এই রাজীব সামদানী ভয়ংকর চতুর ব্যবসায়ী। বিগত সরকারপ্রধানের অত্যন্ত আস্থাভাজন পারিবারিক লোক ছিলেন তিনি এবং সাবেক বিদ্যুৎ ও জ্বালানি প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর বিপুল পরিমাণ অবৈধ টাকা সাদা করার পার্টনার হিসাবেও রয়েছে জনশ্রুতি।

সংশ্লিষ্ট একটি সূত্রের ভাষ্য অনুযায়ী, ১৭ বছরে আর্থিক লুণ্ঠনের মাধ্যমে দেশে একটি বড় চক্র তৈরি হয়। শিল্পকর্ম সংগ্রহ ও কেনাবেচাকে অর্থ পাচারের অন্যতম মাধ্যম হিসাবে গড়ে তোলেন তারা। ঢাকা আর্ট সামিট তাদের একত্র হওয়ার সুযোগকে আরও অবারিত করে তোলে। এ চক্রের সদস্যরা তাদের অঢেল অর্থের একটি অংশ ব্যয় করেন শখের চিত্রকর্ম সংগ্রহের কাজে। এতে দেশের প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের চিত্রকর্মের দামও ক্রমেই বেড়েছে। অভিযোগ আছে, ঢাকা আর্ট সামিটের মধ্য দিয়ে ওই শ্রেণির অংশ হয়ে উঠেছিলেন রাজীব সামদানীও।

রাজীবের রাজকীয় সম্পদ

এরই মধ্যে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে তিনি কানাডা, দুবাইসহ কয়েকটি দেশে সম্পদের পাহাড় গড়েছেন এবং ক্যারিবীয় দ্বীপদেশ সেইন্ট কিটস অ্যান্ড নেভিসের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। সম্পত্তি কিনেছেন যুক্তরাজ্যের লন্ডনেও।

বিতর্কিত কাণ্ড ও গোল্ডেন হারভেস্ট

চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে রাজীব সামদানীকে ৫০ লাখ ১৭ হাজার টাকা জরিমানা করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। সিলেটের গোয়াইনঘাট উপজেলার ফতেহপুরে পাঁচতারকা মানের রিসোর্ট বানানোর জন্য পার্শ্ববর্তী টিলার মাটি কেটে নিজের জমি ভরাটের অভিযোগে তাকে এ জরিমানা করা হয়। পাশাপাশি তার মালিকানাধীন ফতেহপুর এস্টেট লিমিটেডের বিরুদ্ধে অবস্থানগত ছাড়পত্র ছাড়াই এ রিসোর্ট প্রকল্পের নির্মাণকাজ শুরুরও অভিযোগ ছিল।

বর্তমানে অন্য সবকিছু ছাপিয়ে সামদানী আর্ট ফাউন্ডেশনের কর্ণধার ও ঢাকা আর্ট সামিটের উদ্যোক্তা হিসাবেই সবচেয়ে বেশি পরিচিত রাজীব সামদানী। তবে দেশের ব্যবসায়ী অঙ্গনে তিনি প্রথম পরিচিতি পেয়েছিলেন গোল্ডেন হারভেস্ট গ্রুপের অন্যতম কর্ণধার হিসাবে। গ্রুপটির যাত্রা হয়েছিল কমোডিটি ব্যবসার মাধ্যমে। প্রতিষ্ঠানটি পরে হিমায়িত খাদ্যের ব্যবসায়ও যুক্ত হয়।

ভারতীয় একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথ উদ্যোগে দেশে ডোমিনোজ পিৎজা নিয়ে আসেন আহমেদ রাজীব সামদানী। তবে গত দশকে তার গড়ে তোলা ফাউন্ডেশনের প্রতিপত্তি যত বেড়েছে, ততটাই দুর্বল হয়েছে গ্রুপটির তালিকাভুক্ত কোম্পানি গোল্ডেন হারভেস্ট অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ। বন্ডে বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত না দিতে পারার পাশাপাশি রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে নেওয়া অর্থ ভিন্নখাতে ব্যয়ের অভিযোগ রয়েছে কোম্পানিটির বিরুদ্ধে। পাশাপাশি তালিকাভুক্ত কোম্পানির অর্থ ফাউন্ডেশনের জন্য ব্যয়ের অভিযোগও রয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে গোল্ডেন হারভেস্ট গ্রুপের চেয়ারম্যান এবং সামদানী ফাউন্ডেশনের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি আহমেদ রাজীব সামদানীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তার কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, তিনি বর্তমানে দেশের বাইরে অবস্থান করছেন।

দেশব্যাপী কোল্ডচেইন নেটওয়ার্ক স্থাপনের পরিকল্পনার কথা জানিয়েছিল গোল্ডেন হারভেস্ট অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ। এতে যৌথ উদ্যোগে ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনেরও (আইএফসি) সম্পৃক্ত হওয়ার কথা ছিল। যদিও সে উদ্যোগ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। ২০১৯ সালে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যৌথভাবে দেশে ডোমিনোজ পিৎজার ফ্যাঞ্চাইজি ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত হয়েছিল গোল্ডেন হারভেস্ট। যদিও পরে ভারতীয় প্রতিষ্ঠানে নিজেদের ৪৯ শতাংশ শেয়ার বিক্রি করে দেয় গোল্ডেন হারভেস্ট।

জানা যায়, দেশের হিমায়িত খাদ্যের বাজার কিংবা নতুন উদ্যোগ নিয়ে একটি সময় পর্যন্ত আহমেদ রাজীব সামদানী বেশ সক্রিয় ছিলেন। কিন্তু পরে ঢাকা আর্ট সামিটের পরিধি বাড়তে শুরু করলে তিনি তাতেই বেশি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। এতে তালিকাভুক্ত কোম্পানিটির আর্থিক ও ব্যবসায়িক অবস্থা ক্রমেই নিম্নমুখী হতে থাকে। অবশ্য এজন্য কোম্পানিটির পক্ষ থেকে কোভিডের অভিঘাতের প্রভাবের কথা বলা হয়ে থাকে। তবে এর সঙ্গে দ্বিমত পোষণ করে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশের অন্যান্য খাতের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো কোভিডের প্রভাব আরও আগেই কাটিয়ে উঠতে পেরেছে।

গোল্ডেন হারভেস্টের ব্যবসার যাত্রা ১৯৯৭ সালে কমোডিটির মাধ্যমে। পরে তথ্যপ্রযুক্তি, আবাসন, অবকাঠামো উন্নয়ন, লজিস্টিক, ডেইরি, এভিয়েশন ও বিমা খাতের ব্যবসায়ও যুক্ত হয় গ্রুপটি। ২০১৩ সালে দেশের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হয় গোল্ডেন হারভেস্ট অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজ। প্রতিটি শেয়ার ২৫ টাকা (১৫ টাকা প্রিমিয়াম) বিক্রি করে সেসময় পুঁজিবাজার থেকে ৭৫ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করে কোম্পানিটি। ২০১৭ সালে ৫০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করে কোম্পানিটি। এর দুই বছর পর ২০১৯ সালে ৮৯ কোটি ৯৩ লাখ টাকা রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে গোল্ডেন হারভেস্ট।

এ বছরের মার্চ শেষে গোল্ডেন হারভেস্ট অ্যাগ্রো ইন্ডাস্ট্রিজের স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদি ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২১৫ কোটি টাকায়। পুঁজিবাজারে আসার পর থেকে ২০১৮-১৯ হিসাব বছর পর্যন্ত গোল্ডেন হারভেস্টের আয় ও মুনাফার গ্রাফ ঊর্ধ্বমুখী ছিল। তবে ২০১৯-২০ হিসাব বছর থেকেই কোম্পানিটির আর্থিক ও ব্যবসায়িক অবস্থা ক্রমেই নিম্নমুখী। টানা তিন বছর লোকসানে রয়েছে কোম্পানিটি। সর্বশেষ ২০২৩-২৪ হিসাব বছরের প্রথম তিন প্রান্তিকেও (জুলাই-মার্চ) ৬ কোটি ৫৭ লাখ টাকা লোকসান হয়েছে কোম্পানিটির।

পুঁজিবাজার থেকে অর্থ নেওয়ার আগে যে খাতে ব্যয় করার কথা ছিল, সে খাতে ব্যয় না করার অভিযোগও রয়েছে গোল্ডেন হারভেস্টের বিরুদ্ধে। এ বিষয়টি বর্তমানে অনুসন্ধান করে দেখছে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)। সম্প্রতি বিএসইসির কর্মকর্তারা কোম্পানিটির কারখানা পরিদর্শন করে এসেছেন। কোম্পানি রাইট শেয়ারের মাধ্যমে সংগৃহীত অর্থ ঋণ পরিশোধে ব্যয় হয়েছে।

এছাড়া কারখানায় বিনিয়োগ ও রেফ্রিজারেটর কেনা বাবদ যে অর্থ ব্যয় হয়েছে বলে দেখানো হয়েছে, সেটিও প্রকৃতপক্ষে সেখানে ব্যয় করা হয়নি। এছাড়া অব্যয়িত অর্থ ব্যাংকে এফডিআর হিসাবে রাখা হলেও প্রায় এর সমপরিমাণ অর্থ আবার এফডিআরের বিপরীতে ঋণও নিয়েছে কোম্পানিটি। বিএসইসির অনুসন্ধান এখনো চলমান রয়েছে। তবে সংস্থাটির কর্মকর্তারা মনে করছেন, রাইট শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে নেওয়া অর্থ ভিন্নখাতে ব্যয়ের মাধ্যমে সরিয়ে ফেলা হয়েছে।

২০১৭ সালে ৫০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যুর উদ্যোগ নিয়েছিল গোল্ডেন হারভেস্ট। যদিও শেষ পর্যন্ত সংগ্রহ করতে পারে ৩৪ কোটি টাকা। কোম্পানিটির বন্ডে স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক, বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইপিডিসি, আইআইডিএফসি ও ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি বিনিয়োগ করেছে। কিন্তু বন্ড ইস্যুর পর থেকেই এর অর্থ পরিশোধ করছে না কোম্পানিটি। শুরুর দিকে বন্ডে বিনিয়োগের বিপরীতে আংশিক কুপনের অর্থ পরিশোধ করা হলেও পরে সেটিও বন্ধ করে দেওয়া হয়। এ অবস্থায় বন্ডে বিনিয়োগের অর্থ আদায়ে বিএসইসি ও ট্রাস্টি গ্রিন ডেল্টা ক্যাপিটালের দ্বারস্থ হয়েছেন বিনিয়োগকারীরা।

গোল্ডেন হারভেস্টের বন্ডে ১২ কোটি টাকা বিনিয়োগ করেছিল ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি। এখন পর্যন্ত কোম্পানিটি বন্ডে বিনিয়োগের মূল অর্থ ও কুপনের টাকা ফেরত পায়নি। এ বিষয়ে বিএসইসির কাছেও অভিযোগ দিয়েছে বিমা কোম্পানিটি।

এ বিষয়ে ডেল্টা লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘এ বছরের আগস্ট শেষে বন্ডে বিনিয়োগের মূল অর্থ ও সুদ মিলিয়ে ২৩ কোটি ৬৫ লাখ টাকা পাওনা দাঁড়িয়েছে। কিন্তু গোল্ডেন হারভেস্ট অর্থ ফেরত দিচ্ছে না। এ বিষয়ে আমরা ট্রাস্টি ও বিএসইসির কাছে চিঠি পাঠিয়েছি। এখনো পাওনা আদায়ের কোনো ইতিবাচক অগ্রগতি হয়নি।’

গোল্ডেন হারভেস্টের বন্ডে একইভাবে বিনিয়োগ করে বিপাকে পড়েছে ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসি লিমিটেড। বন্ডে বিনিয়োগের বিপরীতে প্রতিষ্ঠানটির পাওনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে ৭ কোটি টাকা। আইআইডিএফসি কর্মকর্তা জানান, ‘দুই বছর ধরে বন্ডে বিনিয়োগের বিপরীতে কোনো রিটার্ন পাচ্ছি না। টাকা আদায়ের জন্য আমরা বিএসইসি ও ট্রাস্টির সঙ্গে যোগাযোগ করেছি।’

গোল্ডেন হারভেস্টের বন্ডের ট্রাস্টির দায়িত্ব পালন করছে গ্রিন ডেল্টা ক্যাপিটাল লিমিটেড। ট্রাস্টির পক্ষ থেকে বন্ডের বিনিয়োগকারীদের অর্থ ফেরত না দেওয়ার বিষয়টি বিএসইসিকে জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে বিএসইসিতে শুনানিতে উপস্থিত হয়েছিলেন গোল্ডেন হারভেস্টের কর্মকর্তারা। তারা অর্থ ফেরত দেওয়ার একটি পরিকল্পনা জানানোর কথা বললেও পরে আর সেটি জমা দেননি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গ্রিন ডেল্টা ক্যাপিটালের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘মূল অর্থ ও কুপনের অর্থ মিলিয়ে পাঁচ বিনিয়োগকারী প্রতিষ্ঠান গোল্ডেন হারভেস্টের কাছ থেকে ৩৯ কোটি ২৯ লাখ টাকা পাবে। অর্থ পরিশোধের বিষয়ে সর্বশেষ ২৯ আগস্ট গোল্ডেন হারভেস্টকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যদিও এখনো এর কোনো জবাব দেয়নি তারা।’

আপনার সামাজিক মাধ্যমে খবরগুলো শেয়ার করুন

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

© All rights reserved by BUD News 24-2025
Developed BY www.budnews24.com