দেশে-বিদেশে প্রভাবশালীদের অবৈধ সম্পদের খোঁজে নেমেছে সরকার। সন্ধান বের করে দেশের অর্থ আত্মসাৎকারীদের স্থানীয় সম্পদ অধিগ্রহণ এবং বিদেশে পাচারকৃত অর্থ পুনরুদ্ধার করা হবে। এ জন্য জোর তৎপরতা শুরু হয়েছে। এরই মধ্যে বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার সহায়তা চেয়ে যোগাযোগও করা হয়েছে।
আর্থিক খাতের বিতর্কিত এস আলম, সামিট, বসুন্ধরা, বেক্সিমকো, ওরিয়ন, নাসা গ্রুপসহ অনেকের তথ্য চেয়ে একাধিক দেশে চিঠি দিয়েছে আর্থিক গোয়েন্দা ইউনিট। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, সিঙ্গাপুর, সংযুক্ত আরব আমিরাতসহ বিভিন্ন দেশে সুনির্দিষ্ট তথ্য চেয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ) থেকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি বিগত সরকারের ঘনিষ্ঠ প্রভাবশালীদের হাতে থাকা ব্যাংকগুলো থেকে কী পরিমাণ অর্থ বের করা হয়েছে, তা যাচাইয়ের কাজ চলছে।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস গতকাল জানিয়েছেন, শেখ হাসিনার শাসনামলে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ও প্রভাবশালী ব্যক্তি নামে-বেনামে ঋণের নামে কত টাকা আত্মসাৎ করে পাচার করেছে, তার হিসাব করা হচ্ছে। এর আগে অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছিলেন, বিদেশে পাচার করা অর্থ ফেরত আনতে সম্মিলিতভাবে কাজ শুরু হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুরও এ কাজে সক্রিয় হয়েছেন। গতকাল তিনি বলেন, এস আলম বিশ্বের ইতিহাসের প্রথম ব্যক্তি, যে পরিকল্পিতভাবে ব্যাংক লুট করেছে। এভাবে পৃথিবীতে কেউ ব্যাংক ডাকাতি করেছে কিনা, জানা নেই। এখন তার নামে-বেনামে থাকা সম্পদ বিক্রি করে আমানতকারীর অর্থ ফেরত দেওয়া হবে। এ মুহূর্তে কেউ যেন এস আলমের সম্পদ না কেনেন, সে অনুরোধ জানান গভর্নর।
বিএফআইইউর একজন কর্মকর্তা সমকালকে জানিয়েছেন, এস আলম, নাসা গ্রুপের নজরুল ইসলাম মজুমদার, সামিটের আজিজ খানসহ কয়েকজনের অর্থ পাচারের আংশিক তথ্য তাদের কাছে রয়েছে। এখন আরও বিস্তারিত তথ্য নেওয়া হচ্ছে। এ জন্য বিভিন্ন দেশের এফআইইউতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এসব তথ্য পাওয়ার পর আইনি ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট দপ্তরে পাঠানো হবে।
তিনি বলেন, সাধারণভাবে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা সময়সাপেক্ষ। কিন্তু সব সংস্থা মিলে জোর চেষ্টা করলে এটা সম্ভব।
ব্যাংক খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, বিগত সরকারের বিশেষ আনুকূল্যে বিভিন্ন উপায়ে ঋণ নিয়ে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার করেছে এস আলম গ্রুপ। গ্রুপটির হাতে ছিল ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী, ফার্স্ট সিকিউরিটি, ইউনিয়ন, গ্লোবাল ইসলামী, বাংলাদেশ কমার্স ও ন্যাশনাল ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ। এসব ছাড়াও অন্যান্য ব্যাংক থেকে অর্থ নিয়েছে গ্রুপটি। সব মিলিয়ে অন্তত ২ লাখ কোটি টাকা নিয়ে তা পাচার করেছে তারা। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও এসব ব্যাংকের কর্মীদের সহায়তায় ভোগ্যপণ্য ব্যবসার আড়ালে অর্থ পাচার করা হয়। অর্থ বের করে নেওয়ায় এখন অনেক ক্ষেত্রেই ব্যাংকগুলো আমানতকারীর অর্থ ফেরত দিতে পারছে না। এস আলম গ্রুপের অনিয়ম ও অর্থ পাচার নিয়ে বেশ আগে থেকে গণমাধ্যমে রিপোর্ট প্রকাশিত হলেও সরকারের দিক থেকে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। উল্টো উচ্চ আদালতকে ব্যবহার করে রিপোর্ট প্রকাশ ঠেকানোর ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
বাংলাদেশ ব্যাংক এরই মধ্যে এস আলমের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেছে পাঁচটি ব্যাংকের পর্ষদ। এ ছাড়া তাঁর সব ধরনের অর্থ উত্তোলনে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে তাঁর মামাতো ভাই সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী জাবেদ পরিবারের নিয়ন্ত্রণ থেকে ইউসিবিকে মুক্ত করা হয়েছে। এখন এসব ব্যাংকের ঋণ, ঋণের বিপরীতে জামানত, নিয়োগ-পদোন্নতিতে অনিয়মের তথ্য যাচাইয়ের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এরই মধ্যে ইসলামী ব্যাংক আলাদা তিনটি অডিট ফার্ম নিয়োগের প্রক্রিয়া শুরু করেছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একটি টিমও ব্যাংকগুলো পরিদর্শন শুরু করেছে। সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংকের অনিয়ম তদন্তে কাজ করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক টিম। অন্য ব্যাংকের বিষয়েও একই রকম ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। ব্যাংকগুলোর নতুন পর্ষদের কাছে কর্মপরিকল্পনা নিচ্ছেন নতুন গভর্নর।
সূত্র: সমকাল